বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৮ অপরাহ্ন
বিএনপির নির্বাচনী আদর্শিক জোট ২০ দল। দীর্ঘদিন ধরে জোটের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অনুপস্থিতির কারণে জোটের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে ভোটে শরীক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক প্রকাশ্যে চললে বদনাম হবে, আবার সম্পর্ক এতোটাই গভীর যে, ইচ্ছে করলেই একে অপরকে ত্যাগ করাও যাচ্ছে না। জামায়াত ইস্যুতে আপত্তি থাকায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তহীনতায় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিতেও যেতে পারছে না বিএনপি। যদিও দলটির নেতারা বলছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য যে কর্মসূচি প্রয়োজন হবে তা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে জোটবদ্ধ কর্মসূচিতে না রাখা হলে জোটে থেকে প্রয়োজনে একক কর্মসূচি পালনে সিদ্ধান্ত জামায়াতে ইসলামীর। বরং তারাও সহজে বিএনপিকে ছাড়বে না, অন্যদিকে বিএনপিও জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না বলেও বিশ্বাস করেন দলটির নেতারা।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নানা কারণে বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামী। বর্তমানে দলটির রাজনৈতিক নিবন্ধন আইনি জটিলতায় ঝুলে আছে। বিগত প্রায় তিন বছর ধরেই বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে নেই জামায়াতে ইসলামী। যদিও সম্প্রতি প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপির অনশন কর্মসূচিতে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এরপর থেকে বিএনপির তৃণমূল নেতাদের ভাষ্য, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপির কর্মসূচিতে পরিকল্পিতভাবে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না তো!
বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। কিন্তু এবার বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে জামায়াত ইস্যুতে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর।
১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ‘১৮ দলীয় জোটে’রূপ পায়। পর্যায়ক্রমে ২০ দলীয় জোট হিসেবে সক্রিয় ছিল।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘ রাজনীতিতে কোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়, নানা মেরুকরণ ঘটে। পরিবেশ পরিস্থিতি ও কৌশলগত কারণেই অনেক সময় অনেক কিছুই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। বিএনপির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এমন বেশকয়েকটি ‘এক নেতার এক দল’ যাদের কোনো জনভিত্তি নাই তারাও নির্বাচন প্রসঙ্গে স্বার্থের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে সমালোচনায় বিতর্ক সৃষ্টি করে, উদ্দেশ্য শুধু বিএনপিই নয় কখনও কখনও সরকারের কাছেও নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরতে পিছপা হচ্ছে না। তবে যদি জোট সম্প্রসারিত হয় বা নিজ-নিজ প্ল্যাটফর্মে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়, সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি থাকার বিষয় নেই।
এদিকে সরকারবিরোধী বেশ কয়েকটি দলের নেতাদের ভাষ্য, জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান জানার পরই তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের বিষয়ে অগ্রসর হবে। শুধু তাই নয়, এমনকি বিএনপিতেও জামায়াত ইস্যূতে রয়েছে ভিন্নমত ও অবস্থান। দলটির নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতারা মনে করছেন জামায়াতে ইসলামী বিএনপির রাজনীতিতে এখন গলার-কাটা। বিএনপিকে সামনে অগ্রসর হতে হলে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়াই পথ হাঁটতে হবে। অন্যথায় এই জামায়াত একদিন বিএনপির রাজনীতিতে বুমেরাং হিসাবে দেখা দিবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়, সরকারও তাদেরকে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিষিদ্ধ করেনি, করেছে কী? তাহলে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জোট এটায় তো দোষের কিছু দেখছি না। বরং আজকে যারা জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছে তাদের সঙ্গেও তো জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে রাজপথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছে। তাহলে এখন সমস্যাটা কোথায়? আসলে ক্ষমতাসীনদের আতঙ্কের নাম বিএনপি। ফলে বিএনপির সঙ্গে যারাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ করবে তাদের বিরুদ্ধেই মিথ্যাচার ও বিতর্ক তৈরি করা সরকারের এজেন্ডা হিসাবে রাখা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণের প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘যুগপৎ’ কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কাজ করছে দলটি দায়িত্বশীল নেতারা।
সংশ্লিষ্ট নেতারা মনে করছেন আপাতত ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ব্যানারে জোটবদ্ধভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করা হবে না। জোটবদ্ধভাবে কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্তও জানানো হয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদের সদস্য ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘শুধু মুখে বললেই তো হচ্ছে না! বাস্তবতা হচ্ছে শত প্রতিকূলতা পরও যেহেতু পিছপা হয়নি তাই এই মুহূর্তে কেন জামায়াতে ইসলামী জোট ছাড়বে, জোটপ্রধান খালেদা জিয়ার বার্তা ছাড়া জামায়াতে ইসলামী জোট ছাড়বে না। আমরা বিএনপির পরীক্ষিত বন্ধু যা উনি (খালেদা জিয়া) অবগত রয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার জীবনদ্দশায় বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারাও ভালো করে অবগত রয়েছেন যে, দীর্ঘদিনের নির্বাচনী জোট সহযোগি জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দিতে চাইলেই সম্ভব হবে না। মূলকথা হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী নিয়ে বিএনপি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিবে না। বরং আগামী দিনে ইসলামী সমমনা দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার বিরোধী প্ল্যার্টফর্মে কিভাবে নিয়ে আসা যায় সে ব্যাপারে আমাদের কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে।’
এদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সরকার হটানোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন তো নয়-ই। দেশের যে পরিস্থিতি যে অবস্থা তাতে এখন সময় এসেছে সরকারকে না বলা। এ সরকারকে বিদায় দিতে আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই। দেশের মানুষের যে ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা, দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং এদেশের মানুষের মালিকানা তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া– এর জন্য সব গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক শক্তি, রাজনৈতিক শক্তি, দল ও ব্যক্তিকে আমরা আহ্বান জানাব। এ স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে এদেশের জনগণকে মুক্ত করি। সেজন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য যে কর্মসূচি প্রয়োজন হবে তা আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নিই।’