বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৪ অপরাহ্ন
আদালত প্রতিবেদক
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে আইসিটি আইনের প্রথম মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক নাসিরুদ্দিন এলানকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াতের আদালত এ রায় দেন।
কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে, অনাদায়ে তাদের আরও ১ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
রায় ঘোষণার আগে তারা আদালতে হাজির হন। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে এদিন বিচারক ৫০ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনান। এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আসামিরা।
মামলার বিবরণে বলা হয় :
ক। ২০১৩ সালের ০৫ই মে ঢাকার মতিঝিলস্থ শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মী সমর্থকদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে গত ১০/০৬/২০১৩ তারিখে ‘অধিকার’ এর ওয়েবসাইটে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যাতে উক্ত সংঘর্ষে ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
উপরন্তু উক্ত প্রতিবেদনে অন্যান্য সংঘর্ষের ছবি এবং বানোয়াট লাশের ছবিও সন্নেবেশিত করা হয়।
খ। উক্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় হতে তথ্য অধিকার আইনে ১০/০৭/০/২০১৩ তারিখে ‘অধিকার’ এর নিকট উক্ত তালিকার বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের আহবান জানানো হয়। তবে ১৭/০৭/২০১৩ তারিখে অধিকার হতে প্রেরিত চিঠিতে সে তালিকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়।
গ। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য প্রেরণ না করার প্রেক্ষিতে ডিবির তৎকালীন এসআই আশরাফুল ইসলাম ১০/০৮/২০১৩ তারিখে গুলশান থানায় একটি জিডি (জিডি নং- ৫১৪) দায়ের করেন এবং উক্ত জিডিমূলে অধিকারের গুলশানস্থ অফিসে অভিযান চালিয়ে আদিলুর রহমানকে গ্রেফতার ও সাক্ষ্যপ্রমান (তিনটি ল্যাপটপ ও দুটি সিপিও) জব্দ করেন।
পরবর্তীতে উক্ত ডিভাইস সমূহের ফরেনসিক সম্পন্ন করে অধিকার কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবিকৃত ৬১ জন মৃত ব্যক্তির একটি তালিকা পাওয়া যায়।
ঘ। বিস্তারিত তদন্ত শেষে আশরাফুল ইসলাম ০৪/০৯/২০১৩ তারিখে ঢাকার সিএমএম আদালতে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের মাধ্যমে দেশ বিদেশে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে আদিলুর রহমান এবং নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র (নন এফআইআর নম্বরঃ ১১৫/১৩, তারিখ : ০৩/০৯/২০১৩) দাখিল করেন।
আদালত উক্ত অভিযোগ পত্র আমলে নিয়ে বিচারের জন্য তা ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালে প্রেরণ করেন যার প্রেক্ষিতে ১১/০৯/২০১৩ তারিখে সাইবার ট্রাইবুন্যালে তথ্য প্রযুক্তি আইনে উক্ত মামলার কার্যক্রম শুরু হয় যার নম্বরঃ ০১/২০১৩।
ঙ। এসআই আশরাফুল ইসলাম কর্তৃক দায়েরকৃত অভিযোগপত্র বিশ্লেষন করে অধিকার প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন এবং নিহতের তালিকায় নানাবিধ অসংগতি তথ্য যায়।
যেমন : উক্ত তালিকায় চারজন (৪) জীবিত ব্যক্তিকে (১। মো. আল আমিন, ২। জাহিদুল ইসলাম সৌরভ, ৩। সোহেল ও ৪। জসিম উদ্দিন) মৃত হিসেবে দেখানো হয়, পাঁচজন (০৫) মৃত ব্যক্তির (১। নাহিদ ও নাহিদ শিকদার, ২। মো. আল আমি ও হাফেজ আল আমিন, ৩। হাফেজ আতাউর রহমান ও মাওলানা আতাউল্লাহ, ৪। মাওলানা শিহাবউদ্দিন ও মাওলানা শিহাবুদ্দিন ও ৫। মো. সাইদুল বারী ও হাফেজ সাইদুর রহমান) নাম দুইবার করে উল্লেখ করা হয়, হার্ট এটাকে মৃত একজন ব্যক্তিকে (কামাল উদ্দিন খান) হেফাজতের ঘটনায় মৃত হিসেবে দেখানো হয়, পৃথক একটি ঘটনায় নিহত ৬ জনের নাম তালিকায় যুক্ত করা হয়, ৭ জন ব্যক্তির পূর্নাঙ্গ পরিচয় প্রদান করা হয়নি এবং ১১ জন ভুয়া ব্যক্তির নাম তালিকায় সংযুক্ত করা হয়।
অর্থাৎ, উক্ত তালিকায় ৬১ জনের মধ্যে ৩৪ জন সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে সংস্থাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টির মানসে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার প্রয়াসেই উক্ত প্রতিবেদন প্রচার করেছে।
চ। উচ্চ আদালতে আদিলুর রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটির কার্যক্রম প্রায় তিনবছর স্থগিত থাকার পর ০৯/০১/২০১৭ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আরো প্রায় চার বছর আটমাস পর ০৫/০৯/২০২১ তারিখে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। সাইবার ট্রাইবুন্যাল আদালতে দীর্ঘ প্রায় দুইবছর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ১৪/০৯/২০২৩ তারিখে মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য করা হয়।
মন্তব্য :
ক। তথ্য প্রযুক্তি আইনে অধিকারের পরিচালক আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সমাপ্তিতে মোট সময় লেগেছে ১০ বছর। মামলায় আদিলুর রহমান সকল ধরনের আইনী প্রক্রিয়া গ্রহনের সুযোগ পেয়েছেন এবং মামলাটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিচালিত হয়েছে।
খ। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবার মতো গর্হিত অপরাধে যুক্ত থাকার পরেও অধিকার এর পরিচালক আদিলুর রহমান এবং নাসির উদ্দিন এলান উক্ত মামলায় স্থায়ী জামিন ভোগ করেছেন।
মামলার বিস্তারিত টাইমলাইন;
১। ১০/০৬/২০১৩ অধিকার এনজিওর ওয়েবসাইটে (www.odhikar.org) ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পুলিশের হামলায় ৬১ জন নিহত হবার মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ।
২।১০/০৭/২০১৩ তথ্য মন্ত্রণালয় হতে তথ্য অধিকার আইনে ‘অধিকার’ এর নিকট উক্ত তালিকার বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের আহবান।
৩।১৭/০৭/২০১৩ অধিকার কর্তৃক চিঠি প্রদানের মাধ্যমে তালিকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো।
৪। ১০/০৮/২০১৩ তথ্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য প্রেরণ না করার প্রেক্ষিতে ডিবির তৎকালীন এসআই আশরাফুল ইসলাম কর্তৃক গুলশান থানায় একটি জিডি দায়ের এবং উক্ত জিডিমূলে অধিকারের গুলশানস্থ অফিসে অভিযান চালিয়ে আদিলুর রহমানকে গ্রেফতার ও সাক্ষ্যপ্রমান জন্দ।
৫। ০৪/০৯/২০১৩ বিস্তারিত তদন্ত শেষে আশরাফুল ইসলাম কর্তৃক ঢাকার সিএমএম আদালতে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচারের মাধ্যমে দেশ বিদেশে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে আদিলুর রহমান এবং নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র দাখিল।
৬। ০৫/০৯/২০১৩ অভিযোগ আমলে নিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহা কর্তৃক অভিযোগ পত্র ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালে প্রেরণ।
৭। ১১/০৯/২০১৩ সিএমএম আদালত হতে প্রাপ্ত অভিযোগ আমলে সাইবার ট্রাইবুন্যাল আদালতে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলার কার্যক্রম শুরু। মামলা নং- ০১
৮। ০৮/১০/২০১৩ উচ্চ আদালতের বিচারপতি বোরহানউদ্দিন ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ হতে আদিলুর রহমানের জামিন লাভ।
৯। ০৮/০১/২০১৪ মামলা হতে অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক কে এম শামসুল আলমের কোর্টে আদিলুর রহমান এবং নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন।
১০। ২২/০১/২০১৪ মামলা হতে অব্যাহতির আবেদন নাকচের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদিলুর রহমান এবং নাসির উদ্দিন এলান কর্তৃক উচ্চ আদালতে দায়ের করা আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি বোরহানউদ্দিন ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ হতে মামলার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান।
১১। ০৯/০১/২০১৭ উচ্চ আদালতের বিচারপতি ইয়ায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্তৃক মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং সাইবার ট্রাইবুন্যালে মামলা চলমান রাখার নির্দেশনা প্রদান।
১২। ০৫/১০/২০২১ ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালের বিচারক আসসামছ জগলুল হায়দারের কোর্টে মামলার বাদী সিআইডির পরিদর্শক আশরাফুল আলমের সাক্ষ্যগ্রহনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু।
১৩। ১৪/০৯/২০২৩ ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালের বিচারক জুলফিকার হায়াত কর্তৃক মামলার রায় ঘোষণা।