বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫১ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ও সংঘাত। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিদিনই গ্রেফতার হচ্ছেন বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গ্রেফতার আতঙ্কে গাঢাকা দিয়েছেন দলটির প্রায় সব নেতা। এ পরিস্থিতিকে বিএনপি বলছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ‘একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা’। যদিও দলটি বলছে, এভাবে আন্দোলন দমন করা যাবে না। বিএনপি নেতানির্ভর দল নয়। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ এবং কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণেই আন্দোলন চলমান বলেও দাবি তাদের। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে তাদেরই কেবল আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকে ‘লক্ষ্যবস্তু’ বানানো হচ্ছে না।
বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করার পর বাকি নেতাদের প্রায় সবাই গ্রেফতারের আশঙ্কায় আত্মগোপন করেছেন। বিশেষ করে দলটি যখন তাদের ‘সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের’ কর্মসূচি পালন করছে তখন সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার বা আত্মগোপন নতুন করে দলটির জন্য সংকট তৈরি করছে কি না, সে প্রশ্ন উঠছে সর্বসাধারণের মুখে।
এর জবাবে দলটির নেতারা বলছেন, গ্রেফতার বা মামলায় সাজা দিয়ে অনেক নেতাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরানো হলেও তাতে দলের অভ্যন্তরে কোনো সংকট তৈরি হবে না। কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, দলটিতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা আছে এবং কেউ গ্রেফতার হলে বিকল্প নেতারাই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। আর দলটি নেতানির্ভর নয়, কর্মীনির্ভর। কর্মীরা তাদের দায়িত্ব বুঝেই কাজ করবেন।
তারা আরও বলছেন, সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে এসে গ্রেফতার এড়াতে কৌশল অবলম্বন করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ কারণেই চলমান হরতাল-অবরোধে রাজপথ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন অনেকে। তবে সাময়িক গাঢাকা দেওয়া নেতারা তফসিলকেন্দ্রিক আন্দোলনে মাঠে নামবেন।
২৮ অক্টোবরে সংঘাতের পর হরতাল কর্মসূচি দেয় বিএনপি। এরপর একে একে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনসহ দলের কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা ও অঙ্গসংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত কেবল ঢাকাতেই মামলা হয়েছে … টি এবং গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপির …. নেতাকর্মী ও সমর্থককে।
অন্যদিকে বিএনপির দাবি, প্রতিদিনই শতশত গ্রেফতার হচ্ছেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের ৪/৫ দিন আগে থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ হাজার ৭৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২৩৩টি, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৪৬ জন এবং ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে (সাংবাদিক একজন)।
বিএনপির একাধিক আইনজীবী জানান, দল এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রয়েছে। এ অবস্থায় ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়েই তারা মাঠে আছেন এবং থাকবেন। এর মধ্যেই হরতাল, অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন নেতাকর্মীরা। এই কর্মসূচি শেষে আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে কর্মসূচির ধরনও পরিবর্তন হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেশের সম্পদ। আমি মনে করি জাতীয় সম্পদকে তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) যেভাবে ব্যবহার করছে তা খুবই কষ্টকর। সরকার গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাগুলো ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে আগাচ্ছে। ‘উদ্দেশ্য’ সফল হবে না ব্যর্থ হবে এটিও অস্পষ্ট। আমি মনে করি, বিএনপি হলো মাঠের কর্মীনির্ভর দল। জনসমর্থন নির্ভর দল। বিএনপি এমন সিচুয়েশনে অনেক সময় পড়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।
খোকন বলেন, মামলা হওয়ার পর আমার সঙ্গে গত ১০ দিন ধরে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। আমি আত্মগোপনে ছিলাম। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, এই ক্রাইসিস মুহূর্তে গ্রেফতার আতঙ্ক হলেও এটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো। আমি মনে করি দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সব কর্মসূচি চলছে। মামলা হামলার ভয় বিএনপি করে না।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী মো. কামরুল ইসলাম সজল বলেন, সরকার যে দমনপীড়ন করবে সেটি জেনেই বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচিতে গেছে। নেতারা গ্রেফতার হলেও আন্দোলন চলবে। দলের নেতাকর্মীরা সরকারের এই কৌশলের সঙ্গে এখন পরিচিত। বিএনপি যখনই আন্দোলন শুরু করে, তারা গণগ্রেফতার করে। কিন্তু এবার আর এই কৌশলে কাজ হবে না। সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত, যত গ্রেফতারই হোক, একজন তৃণমূল নেতা থাকতেও আমরা ঘরে ফিরবো না।
এক দফার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সারাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। একটা অবৈধ সরকার ক্ষমতায় থাকাতে যা ইচ্ছা তাই করছে। ১৬৪ জনকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ। সরকার বা পুলিশ ‘চিহ্নিত করে’ বলেনি যে তারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত। সুতরাং বোঝাই যায়, বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রাজনৈতিকভাবে শায়েস্তা করার জন্য, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে মামলা করে হয়রানি করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো তথাকথিত একটি নির্বাচন দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
তিনি বলেন, কারাগার বিএনপি নেতাকর্মীতে ভরে গেছে। যতই গ্রেফতার করুক, কোনো কাজ হবে না। নির্যাতন, গ্রেফতার করে আর মুক্তিকামী জনতাকে ঠেকানো যাবে না। সবাই সরকারের দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী বলেন, স্বৈরাচার সরকার তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য অতীতের ন্যায় এবারো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। সরকারের একটাই উদ্দেশ্য, দমনপীড়নের মাধ্যমে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো এবারও একটা নির্বাচন করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা।
তবে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হচ্ছে তাদের গ্রেফতার হতে হয়েছে। এখানে সরকার বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রশ্নই আসে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে। এর আগে কখনো প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। তারা বিচার বিভাগের হৃৎপিণ্ডে আঘাত করেছে। এছাড়া পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে। দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও করছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার হতে হয়েছে। এখানে সরকার বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রশ্নই আসে না। তারা অপরাধ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করছে। এখানে সরকারের কোনো উদ্দেশ্য বা টার্গেট নেই।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, ফৌজদারি অপরাধে যারা অপরাধী, অপরাধ করলে তো তারা গ্রেফতার হবেনই। যারা অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এটার সঙ্গে অন্য কোনো বিষয় জড়িত হবে না। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে প্রচণ্ডভাবে ২০১৩ সালের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটার পরিপ্রেক্ষিতে তারা গ্রেফতার হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধের কারণে। এখানে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, রাজনীতি করলে মাঠে থাকেবেনই। সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের কথা হলো, তারা যাতে সন্ত্রাস না করতে পারে। সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে জনজীবন যেন বিপন্ন করতে না পারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের মাথাব্যথা নাই। তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না।