বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৩ অপরাহ্ন
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ভোট এলেই তারকা প্রার্থীদের মঞ্চে আগমন ঘটে। এবারও সেই দৃশ্য। নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই আওয়ামী লীগ শিবিরে ভিড় বাড়ছে তাদের। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হওয়া নিয়ে এক ঝাঁক ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের তারকাদের নাম শোনা যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে এসব নাম উঠে আসছে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান তিন আসনে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফর্ম তুলেছেন।
চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিও ফর্ম নিয়েছেন। নাম শোনা যাচ্ছে চিত্রনায়ক আলমগীর, নায়ক ফেরদৌস, শাকিল খান, অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান, ডিপজল, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচীও।
কোনোদিন রাজনীতির মাঠে থাকেননি, কর্মী নেই, কারও প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই, মামলা নেই, পুলিশি হয়রানি নেই এমনকি দলে সাধারণ সদস্যপদও নেই। তবুও তারা নির্বাচন করতে এসেছেন, তাও জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি কর্মীদেরও প্রশ্ন—এই ইচ্ছে কেন? সিনেমা জগৎ এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, তাই চিত্রজগতের লোকজন হয়তো ভাবছেন, রাজনীতিটাই তো এদেশে বড় সিনেমা। ক্রিকেটও তাই।
যে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতির আবেগ, সেইখানে এখন হতাশা। বিপুল টাকা এসেছে খেলা থেকে, তা-ই এখন রাজনীতিই-বা-বাদ যাবে কেন? আরেকটা বড় কারণ হতে পারে যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা নেই, তাই পাস করে আসাটা সহজ, শুধু নৌকা প্রতীকটা পেলেই হলো।
ভারতে আমরা এটা দেখেছি। তারকারা নির্বাচন করেন। সেইখানে তারকাদের ভোটপ্রার্থী করার একটা বড় কারণ তাদের জনপ্রিয়তা এবং গ্ল্যামারকে ভোটে টানতে ব্যবহার করা। বাংলাদেশের তারকারা কি সেই রকম জনপ্রিয়? তারা ভোট টানতে পারবেন? উত্তরটা নেতিবাচকই হওয়ার কথা।
পাকিস্তানেও ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু একটা দল গঠন করে, জনমত তৈরি করে, নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে সেই পদে বসেছিলেন। আমাদের তারকারা চাচ্ছেন আরাম করে বসে পড়তে।
পুরোটাই তাদের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যেহেতু এসব তারকাদের সেই অর্থে জনভিত্তি নেই এবং তারা তৃণমূল স্তর থেকে রাজনীতি করে আসেননি, রাজনীতিকে কোনোদিন গ্রহণও করেননি, তাই ভবিষ্যতে তারা অর্থ-বিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যই আসছেন। অনেকের জন্য চলচ্চিত্রে কাজের জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে, তাই রাজনীতিই ভরসা।
তারকা ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা নড়াইল থেকে এমপি হয়েছেন আওয়ামী লীগের টিকেটে। এর আগে নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরকেও এমপি-মন্ত্রী হতে দেখেছে দেশের মানুষ। সংগীতশিল্পী মমতাজও আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
তারানা হালিম সংসদ সদস্য হয়েছেন সংরক্ষিত আসনে। তিনি তথ্য প্রতিমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ফুটবলার আরিফ খান জয় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং উপমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারানা হালিম এবং জয় বরাবরই রাজনীতিতে সক্রিয় এবং সেই হিসেবে বলা যায় না যে তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন, যে কথাটা অনেকের বেলায় বলা হচ্ছে। ঢাকা-১৭ আসনে নায়ক ফারুকও এমপি হয়েছিলেন, যিনি স্বাধীনতার পরবর্তী কাল থেকেই পারিবারিকভাবে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন।
বিএনপিতে সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা, বেবী নাজনীন, চিত্রনায়ক হেলাল খান, ফুটবলার আমিনুল ইসলাম সক্রিয়ভাবেই আছেন। সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর ও মনির খানও আছেন খানিকটা। ফুটবলার আমিনুল ইসলাম নিয়মিতভাবে মিছিল মিটিং-এ থাকছেন। প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি ছুটে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি দখলে এগিয়ে আছেন মূলত ব্যবসায়ীরা। একসময় মনে করা হতো বাণিজ্যের সফল উদ্যোক্তারা রাষ্ট্রের কাজে নতুন গতি, উদ্যম ও স্বচ্ছতা আনতে পারবেন। সেই আশা পূরণ হয়নি। উল্টো তাদের সিন্ডিকেট বেড়েছে, অর্থবিত্ত আরও বেড়ে ক্ষমতা যোগ হয়েছে। এদের কাছে মানুষের কোনো মূল্য সেইভাবে নেই।
নির্বাচন করতে দলীয় অফিসে তারকাদের হিড়িক অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যারা আসছেন, তারা যদি আগে রাজনীতিটা করে আসতেন হয়তো ভালো হতো। তা না করে আসায় হঠাৎ করে নির্বাচনের ইচ্ছেটা গোলমেলে লাগছে মানুষের কাছে।
যেহেতু এসব তারকাদের সেই অর্থে জনভিত্তি নেই এবং তারা তৃণমূল স্তর থেকে রাজনীতি করে আসেননি, রাজনীতিকে কোনোদিন গ্রহণও করেননি, তাই ভবিষ্যতে তারা অর্থ-বিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যই আসছেন।
যে নেতা জীবন ও শ্রম বিনিয়োগ করেছেন রাজনীতির পেছনে, সংসারকেও সময় দেননি, সেই মানুষটা একদিন দেখলেন তার আসনটি নিয়ে নিয়েছে এক পাখি, যে এসেছে বিদেশ থেকে ক্ষমতা কেন্দ্রের কারও বন্ধু হিসেবে, কিংবা টিকেটটি কিনে নিয়েছেন বিরাট অর্থ খরচ করে, খেলাধুলা করে বা সিনেমায় অভিনয় করে।
স্থানীয় সরকারসহ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অনেকদিন ধরেই সিনেমা ও নাটকের পরিচিত মুখগুলো প্রচারে অংশ নিয়েছেন। তা নিয়ে শাসক দলের অভ্যন্তরেই অনেক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শাসকদল থেকে ডাক পেলে তো যোগ দেবেনই তারা।
শাসকদলের সঙ্গে জনতার যোগ স্থাপন কমে গেলেই কি এমন হয়? এঈ প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। আবার কেউ কেউ বলছেন ক্ষমতা আর বিত্তের ভাগটা তারকারাও ছাড়তে চান না।
দল করা, দলের নিয়মনীতি জানা রাজনীতির আসল কাজ। তারকাদের তারও প্রয়োজন নেই। প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতে গেলে অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়। সেই বিবেচনা বোধটা নেই কোথাও।
রাজনীতিকরাও সেলেব্রিটি হন অনেক সময়। কিন্তু অরাজনৈতিক সেলিব্রিটিরা রাজনীতিকে কী দেন বা দিতে পারেন আসলে? শাসন ব্যবস্থায় যখন সু-শাসনের চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়, এসব অরাজনৈতিক ব্যক্তি রাজনীতিতে এসে কী-ই বা করতে পারবেন? বাস্তবতা হলো, এই তারকারা তো রাজনীতিতে আসছেন না, তারা করতে চান শুধুই নির্বাচন।
লেখক ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন