শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৯ অপরাহ্ন
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য একই দামে এভিয়েশন ফুয়েল বা জেট ফুয়েল বিক্রির দাবি জানিয়েছে দেশি এয়ারলাইনসগুলো। তাদের দাবি, জ্বালানির দুই রকম দামের কারণে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা দেশি এয়ারলাইনসগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
গত ৭ জুলাই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জেট ফুয়েলের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য প্রতি লিটার জেট ফুয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায় আর আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য ১ ডলার ২২ সেন্ট বা ১১৪ দশমিক ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এ জ্বালানি।
গত বছরের জুলাইতেও উড়োজাহাজের এই জ্বালানি বিক্রি হয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের জন্য ৬৬ টাকায়। আর আন্তর্জাতিকে ৬২ সেন্ট বা ৫২ দশমিক ৭ টাকায় এটি বিক্রি হয়। এ হিসেবে গত এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে জেট ফুয়েলের দাম।
করোনার অভিঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আবারও মন্দাভাব তৈরি হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এর প্রভাব পড়েছে প্রায় প্রতিটি খাতে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। মুদ্রাস্ফীতিতে নাকাল হচ্ছে বিশ্বের শক্তিধর অর্থনীতির দেশগুলোও।
সাধারণত একটি উড়োজাহাজ আকাশে ওড়াতে যে খরচ হয়, তার ৪০ শতাংশই মূলত ব্যয় হয় জ্বালানির পেছনে। তাই জ্বালানির দাম ওঠানামা করলে এর প্রভাব পড়ে ফ্লাইটের খরচে। শেষ পর্যন্ত এই খরচের বোঝা চাপে যাত্রীদের ঘাড়ে।
বাংলাদেশ উড়োজাহাজের জ্বালানি নিজে উৎপাদন করে না। দেশের প্রয়োজন মেটাতে এটি আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আর এটি এয়ারলাইনসগুলোর কাছে সরবরাহ করে পদ্মা অয়েল লিমিটেড।
এয়ারলাইনসগুলো বলছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সাধারণত আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা কম থাকে। মূলত এই সময়টিকে পর্যটনের জন্য অনুপযোগী সময় বলা হয়ে থাকে। এ সময় বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় মানুষ ঘোরাঘুরি কম করে। এর মধ্যে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে এয়ারলাইনসগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়লেও টিকিটের দাম বাড়াতে পারছে না তারা। ফলে কঠিন একটি সময় পার করতে হচ্ছে তাদের।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য জেট ফুয়েলের যে রেট আছে, টাকার হিসাবে দুই ক্ষেত্রে প্রায় ১৬-১৭ টাকার পার্থক্য। প্রতি লিটার ১৬ থেকে ১৭ টাকার এই পার্থক্য পুরোটাই যাত্রীদের ওপর একটি বাড়তি বোঝা। এটা একেবারে সরাসরি আঘাত।
‘আন্তর্জাতিক রুটে আমরা যে ফ্লাইটগুলো পরিচালনা করি, তাতে আধিক্য বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর। তারা একটা সুবিধা পাচ্ছে আর দেশি এয়ারলাইনস এবং যাত্রীরা লুজার হচ্ছে। এটা আমার কাছে মনে হয় আনএথিক্যাল। এটা রিভিউ করার সুযোগ আছে। আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদের কাছ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কিছু দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে একেক দেশ দেশ একেক রকমভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। আমি যখন আমার দেশের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করব, তখন আমার দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখেই এটা করা উচিত।
‘আন্তর্জাতিক বাজারে এখন দাম কমেছে। বিপিসি প্রতি মাসে ফুয়েলের দাম নিয়ে বৈঠক করে। যেদিন বৈঠক করে দাম নির্ধারণ করে, দেখা যায় পরের দিনই এটা কার্যকর হয়, কিন্তু যখন দাম কমে যায়, তখনও তো একটি বৈঠক করে দাম এডজাস্ট করা যেত। এতে তো আমরা অন্তত সেই সুযোগটা পেতাম।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেট ফুয়েলের দুই ধরনের দাম নির্ধারণ করা হয় সাধারণত ভ্যাট নির্ধারণের জন্য, তবে এখনকার বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে এই ভ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে আনলেও খুব বেশি সুবিধা এয়ারলাইনসগুলো পাবে না বলে মত তাদের।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ডমেস্টিকে (অভ্যন্তরীণ) যে প্রাইসটা (মূল্য) সেট করা হয়, সেটার কারণ একটা ভ্যাট নেয়া হয়। যেসব দেশ ভ্যাট নেয় না, তাদের ক্ষেত্রে একই প্রাইস থাকে। আমরা বলেছিলাম এই ভ্যাটের পারসেন্টেজটা (শতাংশ) কমিয়ে দিতে। এখন এটা করেও খুব একটা পার্থক্য হবে না।
‘এতে ডমেস্টিক ফ্লাইট যারা করে, তাদের ওপর কিছুটা চাপ তো পড়েই। কারণ এক বছর আগে যে দামে ফুয়েল পাওয়া যেত, সেটা তো এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে তো শেষ পর্যন্ত ভাড়ায় প্রভাব পড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভাড়া বৃদ্ধিই একমাত্র পথ, কিন্তু এখন তো ভাড়া বাড়িয়েও সুবিধা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে যে দাম ছিল, সেটা ছিল অপারেটিং কস্টের ২৮ থেকে ৩০ ভাগ। এখন বাড়তে বাড়তে এটা ৫০ ভাগে চলে এসেছে। এখন খরচ কমাতে চাইলেও সেটা পারবে না। যেমন: স্পেয়ার পার্টসের দাম বেড়েছে। বেড়েছে কারণ পরিবহন খরচও বেড়েছে। খরচ কমানোর কোনো উপায় আপাতত নেই। একটা উপায় হলো হিউম্যান রিসোর্সে যদি কমপ্রোমাইজ করা যায়।
‘কিন্তু পাইলট আর ইঞ্জিনিয়ারদের যে ঘাটতি রয়েছে, তাতে সেটাও এখন করা সম্ভব না। এতে এয়ারলাইনসগুলো লোকসানে পড়বে। সেটা হয়তো এখন দেখা যাবে না, তবে দুই থেকে তিন বছর পর দেখা যাবে যে, ঘাটতি আর মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। যেমন: ২০০৮ সালে যে ইনফ্লেশনটা (মুদ্রাস্ফীতি) হয়েছিল, সেটার ইফেক্ট (প্রভাব) কিন্তু দুই বছর পরে আমরা দেখেছি। এ ক্ষেত্রেও সে রকম হতে পারে।’
জেট ফুয়েলের দামের কারণে এয়ারলাইনসগুলো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে, এমন যুক্তি মেনে নিতে নারাজ বিপিসি। প্রতিষ্ঠানটির অপারেশনস ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক সৈয়দ মেহদী হাসান বলেন, ‘এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। ডমেস্টিকে বিমানকে কম টাকায় তেল দেয়া হয়। এটা আমাদের ন্যাশনাল ক্যারিয়ারকে কিছুটা স্পেস দেয়ার জন্য। এটার জন্য অপারেশন চ্যালেঞ্জ বড় হওয়ার কথা না, তবে কম-বেশির কারণে তাদের মনে কিছুটা কষ্ট থাকতে পারে।
‘শুধু বিমান না, যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন জাহাজের ক্ষেত্রে শিপিং করপোরেশনের জাহাজে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার কারণে আমাদের করতে হয়।’
বিশ্ববাজারে জেট ফুয়েলের দাম নিম্নমুখী হওয়ায় দেশেও দাম কমতে পারে বলে ধারণা দেন মেহদী। তিনি বলেন, ‘আপাতত তেলের দাম নিচের দিকে। এভাবে কমতে থাকলে কতটুকু আশাবাদী হব, বুঝতে পারছি না, তবে আগামী সপ্তাহেও যদি এটা কমার দিকে থাকে, তাহলে আমরা পুনরায় নতুন দাম ঘোষণা করব।
‘বিমানের ক্ষেত্রে এক মাস আর অন্যদের ক্ষেত্রেও আমরা দাম কম-বেশি এডজাস্ট করি। পরবর্তী মিটিংয়েই হয়তো এটা আবার অ্যডজাস্ট হয়ে যাবে।’
গত ২৫ বছরে দেশে ১০টি বেসরকারি এয়ারলাইনস যাত্রা শুরু করলেও এখন টিকে আছে দুটি। এ সময়ের মধ্যে একে একে পাখা গুটিয়েছে অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবত, রয়্যাল বেঙ্গল, এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইনস, বেস্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার ও রিজেন্ট এয়ার।
করোনার মধ্যে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে রিজেন্ট এয়ার। কয়েক দফা চালুর কথা বললেও আর ফ্লাইটে ফেরেনি তারা। বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে জিএমজি, রিজেন্ট ও ইউনাইটেড আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও চালাত।
দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়া ফ্লাইটে রয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ারের। এ ছাড়া আরও দুটি নতুন এয়ারলাইনস ফ্লাইটে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ফ্লাই ঢাকা ও এয়ার অ্যাসট্রা।
কাগজের সংবাদ/মেহেদী হাসান